অপারেশন সার্চলাইট এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৫ শে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী বাহিনীদের দ্বারা পরিচালিত হয় অপারেশন সার্চলাইট। অপারেশন সার্চলাইটের নাম দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশের মানুষকে গণহত্যা করে। ২৫ শে মার্চে এ অভিযান পরিচালনা করলেও এর পরিকল্পনা করা হয়েছিলো মার্চের প্রথম দিকে।

নিম্নে অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা কিভাবে করা হয়েছিলো, তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

  • ৭ মার্চের ভাষণ এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সাথে সমঝোতা বৈঠক শুরু হয়। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
  • ১৮ মার্চ আরমান আলী, ফরমান আলী ও টিক্কা খান অপারেশন নীলনকশা তৈরী করে।
  • ১৮ মার্চ আরমান আলী, ফরমান আলী ও টিক্কা খান অপারেশন নীলনকশা তৈরী করে।
  • ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয়।
  • অবশেষে লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের সার্বিকভাবে এই পরিকল্পনার তত্ত্বাবধান করে ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করে।

অপারেশন সার্চলাইটের পটভূমিঃ

অপারেশন সার্চলাইটের অর্থ হলো সবকিছু ধ্বংস করে হলেও মাটির উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা। ঢাকার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং অন্য সব স্থানের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় মেজর জেনারেল খাদিম হাসেন রেজাকে। গণহত্যা করার পূর্বে পাকিস্তান আর্মি তে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের হত্যা কিংবা গ্রেপ্তার কারার চেষ্টা করা হয় । অপারেশন সার্চলাইটের কথা যাতে বিশ্ববাসী না জানে, এর জন্য বিদেশী সাংবাদিকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ২৫ সে মার্চের রাতে রাজার বাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ইবিআরসি, ঢাকার পিলখানা সহ সারাদেশের সাময়িক এবং বেসাময়িক মানুষ হত্যা করে।এর ফলে অনেক মানুষ মারা যায়। ঢাকা পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরিতে। তখন ডেইলি টেলিগ্রাফের বিখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৫ শে মার্চের বর্বরতা কিছুটা তুলে ধরেছিলেন।

বাংলাদেশের প্রথম সরকার

মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য এবং বাংলাদেশ কে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এই সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এই সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে শপথ গ্রহণ করে, কিন্তু কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে। তাই এই সরকার কে প্রবাসী সরকার বলে আখ্যায়িত করা হয়।

দপ্তর সমূহ:

১২ টি দপ্তর বা মন্ত্রনালয় নিয়ে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। নিম্নে মুজিবনগর সরকারের ১২ টি দপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের কর্যক্রম তুলে ধরা হলো-

নামপদবীমন্ত্রণালয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানরাষ্ট্রপতিছিল না।
সৈয়দ নজরুল ইসলামউপ-রাষ্ট্রপতিতিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তাজ উদ্দিন আহমেদপ্রধানমন্ত্রীপ্রতিরক্ষা, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য প্রচার, অর্থনৈতিক, উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম এবং সমাজকল্যান, সংস্থাপন।
খন্দকার মোশতাক আহমেদমন্ত্রীপররাষ্ট্র, আইন এবং সংসদ বিষয়ক
এ এইচ এম কামরুজ্জামানমন্ত্রীকৃষি, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন, সরবারাহ, স্বরাষ্ট্র।
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীমন্ত্রীশিল্প ও অর্থ-বাণিজ্য।

উপদেষ্টা পরিষদ:

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কে প্রধান করে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়।

বাংলাদেশের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ এর নাম।

বাংলাদেশে যেই ৭ জন কে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হয়। তারা সবাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাদের নাম নিম্নে দেওয়া হলো।

  1. বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ।
  2. বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল।
  3. বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান।
  4. বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ।
  5. বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান।
  6. বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ রুহুল আমিন।
  7. বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

মুক্তিযুদ্ধে সম্মানসূচক পদবীর নাম এবং বর্ণনা

৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে বাংলদেশ স্বাধীন হয়। তাই তাদেরকে সম্মান প্রদান করার জন্য ৪ টি সম্মান সূচক খেতাব তৈরী করে। এই ৪ টি খেতাব পেয়েছে ৬৭৬ জন। কিন্তু কোনো জীবিত ব্যক্তি বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পান নি। নিম্নে খেতাবগুলোর নাম এবং পদ-মর্যদা প্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা তুলে ধরা হলো।

খেতাবসংখ্যা
বীরশ্রেষ্ঠ
বীবউত্তম৬৮
বীর বিক্রম১৭৫
বীর প্রতীক৪২৬

মুক্তিযুদ্ধে নারী, শিশু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩ লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। যাদেরকে বীরঙ্গনা খেতাব দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী শিশু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিশেষ অবদান রেখেছিলো। যার ফলে তাদেরকে ২০১৫ সালে বিশেষ খেতাব দেয়া হয়। নিম্নে এই ব্যাপারে আলোচনা করা হলো; যাতে আপনি খুব সহজে ভুগতে পারেন।

মুক্তিযুদ্ধে নারী, শিশু ও ক্ষুদ্ৰ নৃগোষ্ঠী সম্পর্কিত তথ্য-

  • বাংলাদেশে বীর খেতাব প্রাপ্ত নারীর সংখ্যা ২ জন।
  • ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন সেতারা বেগম।
  • কাকন বিবি, তিনি মুক্তিবেটি নামে পরিচিত।
  • ২০১৫ সালে বীরঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেওয়া হয়।
  • মোঃ শহিদুল ইসলাম লালু, বাংলদেশের সর্ব কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা।
  • উক্যাচিং মারমা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বীর বিক্রম খেতাব পায়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যেভাবে জন্ম

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এবং এই বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি এবং মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যেভাবে জন্ম নিয়েছিল তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-

আওয়ামীলীগ এর অবদান

চট্টগ্রামের কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের উদ্যোগে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হতে প্রয়জনীয় যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট প্রেরণ করে একটি অস্থায়ী কেন্দ্র তৈরী করা হয়।

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র

অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র নির্মাণের পর এর নাম দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। কিন্তু পরে জিয়াউর রহমানের অনুরোধে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র”।

বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমান এর অবদান

২৭ মার্চ বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এর নিরাপত্তার জন্য মেজর জিয়ার সাহায্য চাওয়া হয়। তখন তিনি ৩ লরি ভর্তি সিপাহি বেতার কেন্দ্রে প্রেরণ করেছিল। এবং কয়েকজন ক্যাপ্টেন সোহো জিয়াউর রহমানও যাত্রা করেছিলেন। বং ২৭ মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

কিন্তু ৩০শে মার্চ হানাদার বাহিনীর বোমা হামলায় বেতার কেন্দ্র নিরব হয়ে যায় । পরে আগরতলা হতে এবং ২৫ মে কলকাতার বালিগঞ্জ বেতার কেন্দ্র থেকে আবার নিয়মিত সম্প্রচার শুরু করে।

অনুষ্ঠান মালা

স্বাধীন বাংলা বেতারের জনপ্রিয় দুটি অনুষ্ঠান ছিল।যার নাম,

১. চরমপত্র।

২. জল্লাদের দরবার।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী নাগরিকদের নাম ও অবদান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিছু বিদেশী নাগরিকের অবদান ভুলার মতো না।তাদের জন্য ১৯৭১ এর যুদ্ধের বিবরণ ও কারণ বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা হয়।নিম্নে বিদেশী নাগরিকদের নাম তুলে ধরা হলো-

ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড

পেশায় তিনি একজন সাংবাদিক এবং নেদারল্যান্ডের নাগরিক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট এর সময় সারা রাত লুকিয়ে লুকিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর ভয়াভতা ক্যামেরাবন্দী করেন।

ফাদার ভিডিও ভেরেনজি

তিনি ছিলেন ইটালির নাগরিক এবং যশোরের একটি গীর্জায় কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি বাঙালি নাগরিকদের গীর্জায় আশ্রয় দিতেন। যাতে পাকিস্তানী বাহিনী থেকে নিরাপদ থাকে।

জুলিয়ান ফ্রান্সিস

তিনি ছিলেন যুক্তরাজ্যের নাগরিক। যুদ্ধের সময় তিনি অক্সফাম ত্রান কার্যক্রমের জন্য কলকাতায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।

অ্যালেন গিন্সবার্গ

মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে যশোরের সীমান্ত এলাকার শরণার্থী শিবিরে আসে । এবং সেখানের মানুষের কষ্ট প্রত্যক্ষভাবে দেখে। এবং শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটি কবিতা লিখেন, যার নাম “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড”।

আর্চার কে ব্লাড

তিনি ছিলেন মার্কিন কনসাল জেনারেল, এবং তিনি লিখালিখি করতে পছন্দ করতেন। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা করে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার গ্রন্থের নাম ছিল “দ্য ক্রুয়েল বার্থ অফ বাংলাদেশ”।

জর্জ হ্যারিসন

১৯৭১ সালে বাংলদেশের অসহায় মানুষদের সাহায্য করার লক্ষ্যে তিনি একটি কনসার্ট এর আয়োজন করেন এবং কনসার্ট থেকে আয় হওয়া সম্পূর্ণ টাকা তিনি বাংলাদেশের অসহায় মানুষের জন্য ব্যায় করেন।

বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবস (১৫ আগস্ট) কিভাবে পালন করা হয় ?

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি লজ্জাজনক দিন যা জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হয়। এই দিনে ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রাহমানকে এবং তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

এরপর থেকে ১৫ আগস্টে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়।এই দিন সরকারী, সাংগঠনিক, শিক্ষাগত এবং অন্যান্য ভবনে পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় থাকে।এই দিন সরকারী, সাংগঠনিক, শিক্ষাগত এবং অন্যান্য ভবনে পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় থাকে।এই দিনে আওয়ামী লীগ সকালে তাদের সকল দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করে।এছাড়া, আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্যরা মসজিদ, গীর্জা এবং প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করে থাকে।

  • এই দিনে, প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতার কবরে শ্রদ্ধা জানান।
  • বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে একটি বিশেষ ভাষণ দেন।
  • সকল রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগবিভিন্ন কর্মসূচির ব্যবস্থা করে।
  • বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি জাতীয় টিভি (বিটিভি) জাতির পিতাকে উৎসর্গ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫; এই তারিখ বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন ভুলবে না।